কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
আমরা অনেকেই জানি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। এই কনটেন্টটিতে কাজী নজরুল ইসলাম এর পরিচয় এবং 'আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে' কবিতাটি এবং লেখক পরিচিতি পাঠ পরিচিতি ও শব্দার্থ ও টিকা উপস্থাপন করা হয়েছে।👇
পেজ সূচিপত্র : কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
- কাজী নজরুল ইসলাম (কবি-পরিচিত)
- কবিতা (আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে)
- কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে (শব্দার্থ ও টিকা)
- কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে (পাঠ-পরিচিতি)
কাজী নজরুল ইসলাম (কবি-পরিচিত)
কবি-পরিচিত : কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সনে (২৪ শে মে ১৮৯৯ সালে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রাম জন্মগ্রহণ করেন। ছেলে বেড়ায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান।
সেখানেই তার সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে। তার লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্নোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভায় স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তার অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান করে।
আরো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম - (কবিতা-মানুষ)
তার রচিত কাব্য গুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তর বেদন, শিউলিমালা, মিত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তার রচিত গল্প ও উপন্যাস। যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ২৯ শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
কবিতা (আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে)
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
কাজী নজরুল ইসলাম
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখে হাসি মোর চোখে হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে কই জাগাল জোয়ার দুয়ার ভাঙা কল্লোল!
আসল হাসি, আসল কাঁদন,
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে-
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ,
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিনাক-পাণির শূল আসে !
ঐ ধুমকেতু আর উল্কাতে
চাই সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ভুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ,
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ ভাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগবালিকার পীতরাসে;
আজ রঙন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল, সুদূর,
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে !
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসলো শিশির দুবঘাসে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ জাগল সাগর, হাসলো মরু,
কাঁপল ভূধর, কানন-তরচলে
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৌরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্রোজাত জরায়-মরা বামপাশে !
মন ছুটছে গো আজ বল্গা-ধারা অশ্ব যেন পাগলা সে !
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।।
কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে (শব্দার্থ ও টিকা)
শব্দার্থ ও টীকা: উল্লাস - পরম (বা চূড়ান্ত) আনন্দ, হৃষ্টতা। সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে - সৃষ্টি করতে পারার পরম আনন্দ। পল্বল - বিল, ক্ষুদ্র জলাশয়। রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে - প্রাণের বদ্ধ জলাশয়ে বা প্রাণ রূপ জলাশয়। কল্লোল - জলস্রোতের কলকল শব্দ , মহা তরঙ্গ বা ঢেউ । রুদ্ধ প্রাণের ... কল্লোলে - প্রাণ রূপ জলাশয়ে দুয়ার ভাঙা ঢেউ বা তরঙ্গ জোয়ার-এনেছে। হুতাশ - অগ্নি, হুতাসন । শ্বসল - নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল । শ্বসল হুতাশ - অগ্নি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল-অর্থাৎ আগুন অতি তেজের সঙ্গে জ্বলে উঠলো। চক্র - চাকা । এখানে হিন্দু পরাণমতে দেবতা বিষ্ণুর হাতে অন্যায় ধ্বংসকারী চাকাকে বোঝানো হয়েছে। পিনাক - হিন্দু পরাণমতে দেবতা শিবের ধনু।
পিনাকপাণি - পিনাক পাণিতে (হাতে) যার, শিব শূল - এখানে হিন্দু করাণমতে দেবতা শিবের হাতের ত্রিশূলকে বোঝানো হয়েছে। ফাগুন - ফাগুন বা বসন্তকাল। মদন - হিন্দু পুরাণমতে প্রেমের দেবতা। মদন মরে খুন মাখা তূণ - প্রেমের দেবতা মানুষের হৃদয়ে তীর বিদ্ধ করেন বলে তা হৃদয়ের রক্ত মাখা বলে মনে করা হচ্ছে। ঘায়েল - আহত, আঘাতপ্রাপ্ত। এখানে বসন্তকালের রঙে রঙ্গিত বোঝানো হয়েছে। ফাগ - আবির, নানান রঙ্গের গুড়ো। পীত - হলুদ রং হলদে। দিগবালিকার পীতবাসে - দিগন্ত রূপ বালিকার হলুদ রঙের বস্ত্রে বা বসনে। গাজন - (পরাণমতে) চৈত্র মাসের শেষ (অর্থাৎ বসন্তকালে) দেবতা শিবকে নিয়ে গান।
আরো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম
আশিন - আশ্বিন মাস। দুব - দুর্বা, এক রকমের ঘাস। উছলে - উচ্ছলিত। উজান - স্রোতের বিপরীত দিকন। ভৈরবী - শিব অনুসারী সন্ন্যাসিনী, ভয়ংকরী। বিশ্বডুবাল .... গান ভাসে - স্রোতের বিপরীত দিক থেকে ঠেলে বিশ্ব ডোবানো ঝড় এসেছে, তার সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্যকারী শিবের অনুসারী সন্ন্যাসিনীদের গান মিলেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে (পাঠ-পরিচিতি)
পাঠ-পরিচিতি : কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার অন্যতম একটি হলো 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'। কবিতাটি তার দোলনচাঁপা কাব্য থেকে সংক্ষিপিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। এই কবিতায় কবির সৃষ্টি সুখের আনন্দ অসাধারণ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। কবির ভাবনায়, বিশ্বাসে ও জাগতিক নিয়মে এতদিন যা ছিল রুদ্ধ তা যেন আজ শত ধারায় উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই এখন তিনি অনুভব করেন সৃষ্টির কোলাহল, গতির উন্মাদনা, প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মুক্তির আনন্দ।
আরো পড়ুন: চিঠি লেখার নিয়ম - চিঠির খাম লেখার নিয়ম
এই অফুরন্ত ভাবাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কবি যে কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা একেবারেই নতুন। এই কবিতার মধ্যে নজরুলের কাব্য প্রতিভার সকল মাত্রার আনন্দিত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। একইভাবে মানব সত্তার চিরন্তর উল্লাস ও জীবনমুখীতাও প্রকাশ পেয়েছে।
ধন্যবাদ-Thanks
আর আইটি ফার্মের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url